আদানিকে বিদ্যুত বিল পরিশোধে ব্যর্থ সরকার:বাড়ছে লোডশেডিং
টাচ নিউজ: ধবাংলাদেশ আদানি পাওয়ারকে ঋণ পরিশোধ বাবদ জুলাই মাসে ৩৫ মিলিয়ন, সেপ্টেম্বরে ৬৮ মিলিয়ন এবং অক্টোবরে ৯৭ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। আর বকেয়া পরিশোধের পরিমাণও ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি সর্বশেষ আদানি গ্রুপকে ১৭০ মিলিয়ন ডলার ক্রেডিট চিঠি ইস্যু করেছে বাংলাদেশ। তারপরও আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে তা পুরোপুরি বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছে। আদানি কয়লার দর অতিরিক্ত ধরে এ ধরনের হুমকি এমন একসময়ে দিচ্ছে যখন বাংলাদেশে কয়লাচালিত প্ল্যান্টগুলো ৫০% ক্ষমতায় চলছে এবং ডলার সঙ্কটের কারণে পর্যাপ্ত কয়লা আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
অথচ শ্রীলঙ্কায় আদানির একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দেশটিতে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ ধরনের অসম চুক্তি পুনরায় বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। এও বলা হয়েছে যে, আদানি আন্তর্জাতিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে যা অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশেও আদানি বিদ্যুৎ রফতানি করছে ১২ টাকা ইউনিটে, যা বাংলাদেশে উৎপাদিত বিদ্যুৎমূল্যের চেয়ে বেশি। কিন্তু আদানির সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের করা অসম চুক্তির পুনর্বিবেচনার দিকে আগায়নি অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে আদানি উল্টো হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। সামনে সেচ মৌসুম জেনেও আদানি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে বকেয়া পাওনাকে জিম্মি করছে।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বিবিসিকে বলেছেন, তারা ধীরে হলেও আদানিকে নিয়মিত অর্থ প্রদান করবেন এবং অর্থপ্রদানের সঙ্কট সমাধানে আত্মবিশ্বাসী। অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ফয়জুল কবির খান বলেছেন, ‘আমরা হতবাক এবং বিস্মিত যে, আমাদের অর্থপ্রদান বৃদ্ধি করা সত্ত্বেও, আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ হ্রাস করছে। আমরা বকেয়া শোধ করতে প্রস্তুত এবং বিকল্প ব্যবস্থা করব; কিন্তু কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীকে আমাদের জিম্মি করতে এবং ব্ল্যাকমেইল করতে দেবো না।
বিবিসির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকা ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের ঘাটতিতে ভুগছে। আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ হ্রাসের সিদ্ধান্ত আগামীতে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ৮০০ মিলিয়ন ডলারের অপরিশোধিত বিলের কারণে ভারতীয় বিদ্যুৎ কোম্পানি আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে কমিয়ে দেয়ার পরে বাংলাদেশ অর্থপ্রদান বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১০% সরবরাহ করে আদানি। আদানি পূর্ব ভারতের ১৬০০ মেগাওয়াট কয়লাচালিত প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। সংস্থাটি বাংলাদেশে তার সরবরাহ কমানোর বিষয়ে বিবিসির প্রশ্নের জবাব দেয়নি। এর ফলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎঘাটতির কবলে পড়েছে। আদানি ৭ নভেম্বরের মধ্যে বকেয়া টাকা পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোটাই স্থগিত করার হুমকি দিয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা
বিদ্যুৎ, কয়লা এবং তেলের মতো ব্যয়বহুল প্রয়োজনীয় আমদানির জন্য বাংলাদেশ ডলারের রাজস্ব আয় করতে হিমশিম খাচ্ছে। কয়েক মাস ধরে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে, যা আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।
এর স্থলাভিষিক্ত অন্তর্বর্তী সরকার তার বিদ্যমান ৪.৭ বিলিয়ন বেলআউট প্যাকেজ ছাড়াও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে অতিরিক্ত তিন বিলিয়ন ঋণ চেয়েছে।
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশের সাথে আদানির বিদ্যুৎচুক্তিটি শেখ হাসিনার অধীনে অনেকগুলোর মধ্যে একটি ছিল, যাকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অস্বচ্ছ বলে অভিহিত করেছে। একটি জাতীয় কমিটি এখন ১১টি পূর্ববর্তী চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন করছে, যার মধ্যে আদানির সাথে একটি চুক্তি রয়েছে, যা প্রায়ই ব্যয়বহুল হিসাবে সমালোচিত হয়েছে।
শুধু আদানি নয় অন্যান্য ভারতীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা যেমন এনটিপিসি এবং পিটিসি ইন্ডিয়া লিমিটেডের মতো ভারতীয় বিদ্যুৎ সরবরাহকারীদের পাওনা অর্থ পরিশোধও করা হচ্ছে। অথচ আদানির কাছ থেকে বিনা টেন্ডারে বেশি দর দিয়ে কেনা এ বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রেখেছিল বিগত সরকার। একই সাথে আদানি কয়লার দাম বেশি ধরে সেই টাকা পরিশোধ করতে বলছে। কয়লার চড়া দাম দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে পিডিবি। বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানির নামে ঋণপত্র (এলসি) খোলার কথা ছিল ৩০ অক্টোবরের মধ্যে। এই ঋণপত্র খোলার কথা ছিল কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে; কিন্তু সেটি হয়নি। পিডিবি আরো সময় চেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় আদানি। ভারতের ঝাড়খন্ডের গড্ডায় এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গত শুক্রবার দিনের বেলা আদানি গ্রুপ মাত্র ৭২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে বাংলাদেশে লোডশেডিং দেখা দেয়।
অথচ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ না দিলে আদানির একটি ৮০০ মেগাওয়াটের ইউনিট বেকার পড়ে থাকবে। যদি তারা বাংলাদেশের কাছ থেকে মাসে ৯০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার করে বিল নিতে পারে তাহলে বছরে এক বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ শঙ্কাজনক অবস্থায় হ্রাস পাওয়ার পর ডলারের সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। আশার কথা বাংলাদেশের রিজার্ভ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে; কিন্তু তর সইছে না আদানির। ভারতীয় এ কোম্পানিটি আলটিমেটাম দিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ডলার সঙ্কটের মধ্যে কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে পিডিবি এলসি ইস্যু করলেও তা বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি অনুযায়ী ছিল না। আদানির ঋণ পরিশোধে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সদিচ্ছার ঘাটতি নেই। গত ৩১ অক্টোবর আদানি গ্রুপ তাদের ঝাড়খন্ডের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে আনে। বাগেরহাটের বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং এসএস পাওয়ারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কয়লা সঙ্কটের কারণে ইতোমধ্যে অর্ধেক ক্যাপাসিটি নিয়ে চলছে।
এ দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি মেটানোর জন্য বাংলাদেশ কিছু গ্যাস-চালিত এবং তেল-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুনরায় চালু করছে। শীত এলে এয়ার কন্ডিশনার বন্ধ থাকায় গ্রিডে বিদ্যুতের চাহিদা হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ তার জালানি শক্তির মিশ্রণে বৈচিত্র্য আনতে ডিসেম্বরে তার প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর পরিকল্পনা করছে। রুশ সহায়তায় নির্মিত, এটির ব্যয় ১২.৬৫ বিলিয়ন, বেশির ভাগই দীর্ঘমেয়াদি রুশ ঋণে অর্থায়ন করা হয়েছে।