ক্যাসিনো গুরু সেলিম মিয়াকে নিয়ে আলোচনার ঝড়
স্টাফ রিপোর্টার : দেশের আলোচিত ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম মিয়া ওরফে ডন সেলিম হঠাৎ নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জকে মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত করার ঘোষনা দেওয়ায় তাকে নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে রুপগঞ্জসহ পুরো নারায়ণগঞ্জজুড়ে। যিনি নিজেই মাদক স¤্রাট, ক্যাসিনো গুরু, থাই ডন, স্পা ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজদের সর্দার হিসেবে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাইরে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি কিভাবে রুপগঞ্জকে মাদক,সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধ মুক্ত করবেন এমন ঘোষনা দেওয়ায় রুপগঞ্জের পাড়া মহল্লায় তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ব্যাংকক যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সেলিম প্রধানকে আটক করে র্যাব-১। পরে গুলশান ও বনানীর বাসা, অফিসে অভিযান চালিয়ে ২৯ লাখ টাকা, বিপুল বিদেশি মদ ও বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে উদ্ধার করা হয় হরিণের চামড়া। ওই দিনই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়ে সেলিম প্রধানকে কারাগারে পাঠান ভ্রাম্যমাণ আদালত। দুদকের একটি মামলায় আট বছরের সাজা হয় সেলিম প্রধানের। এদিকে, হুট করে রূপগঞ্জে এই ক্যাসিনো স¤্রাটের ফিরে আসাকে অশনি সংকেত বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
অনুসন্ধান ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানাগেছে, উপজেলার গাউছিয়া মর্তুজাবাদ গ্রামে ১৯৭৩ সালে সেলিম প্রধানের জন্ম। বাবা ‘চাঁন মিয়া ও তার মায়ের নাম সফুরা খাতুন। ১২-১৩ বছর বয়সে ভাইয়ের সঙ্গে জাপান চলে যান তিনি। জাপানে গিয়ে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেখানে কে-১ ফাইটিং গ্রুপ তৈরি করেন। একসময় ‘জিরো ওয়াত্তা’ নামে এক জাপানি বক্সার ও আন্ডারওয়াল্ডের সদস্যের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। জাপানে পাসপোর্ট নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে সেখানকার চিফ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে মারধর করেছিলেন সেলিম মিয়া। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জাপানে জেলও খাটেন তিনি। এরপর জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান সেলিম। সেখানে কিছু দিন থাকার পর দেশে ফেরেন। কিছুদিন পর আবার থাইল্যান্ড যান সেলিম। সেখানে তার একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা রয়েছে। এক সময়ের সেলিম মিয়া এখন ডন সেলিম নামে সারাদেশে পরিচিত। তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। এক যুগ আগেও সেলিম মিয়ার পরিচয় ছিলো শুধু গাউছিলার মর্তুজাবাদ এলাকার চাঁন মিয়ার ছেলে হিসেবে। সময়ের ব্যবধানে এখন তিনি ক্যাসিনো স¤্রাট ডন সেলিম প্রধান নামে পরিচিত লাভ করেছেন। সেলিম প্রধানের পৈতৃক বাড়ি এমন জরাজীর্ণ থাকলেও গাউছিয়া থেকে অল্প দূরেই ভুলতা ফ্লাইওভারের শেষ মাথায় সাওঘাট এলাকায় সেলিম প্রধানের সেই আলোচিত ‘জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস’ নামের বহুতল প্রতিষ্ঠান। যেখানে ছাপানো হয় বাংলাদেশের সব ব্যাংকের চেক বই, এফডিআরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আন্ডারওয়াল্ডের ডন সেলিম প্রধান ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে বিদেশ যাওয়ার সময় তার লাগেজের সঙ্গে অনেক মালপত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন। লাগেজ তল্লাশি করে পাওয়া যায় তিনটি মেমোরি কার্ড। পরে ওই কার্ড পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেখানে রয়েছে দেশি-বিদেশি তরুণীদের সঙ্গে অনেক ভিআইপির অন্তরঙ্গ ছবি। জিজ্ঞাসাবাদে জানতে চাওয়া হয়, কেন ওই মেমোরি কার্ড থাইল্যান্ডে নিয়ে যাচ্ছিলেন- এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি সেলিম মিয়া। তবে গোয়েন্দারা বলেছেন, এসব ভিডিও দেখিয়ে ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সেলিম প্রধানের। বিদেশে বসে ভিআইপিদের গোপন ভিডিও প্রচার ও প্রকাশের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সংস্থা সেলিমের সহকারী মাসুমকে জিজ্ঞাসাবাদ করায় বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। তিনি সেলিমের রংমহলের অনেক তথ্য দিয়েছেন। গুলশানে সেলিমের বাসা থেকে অসামাজিক কাজে ব্যবহার হতো, এরকম অনেক আলামত পাওয়া গেছে। মাসুম জানান, সেলিমের নির্দেশে বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে গোপন ক্যামেরা কিনে গুলশানের বাসায় লাগানো হয়। গোপনে ভিআইপিদের ছবি ধারণ করার দায় সেলিম প্রধানের। গুলশানে তার রংমহলে যারা নিয়মিত যেতেন তাদের ‘প্রধান ক্লাবের’ সদস্য করে নিতেন সেলিম। ‘প্রধান ক্লাবে’ একবার কেউ নাম লেখালে সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন ছিল। মূলত এই রংমহলের আনঅফিসিয়াল নাম ছিল প্রধান ক্লাব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, এমন কোনো খারাপ দিক নেই যেটা ডন সেলিম মিয়ার ছিলো না। বিএনপি জামায়াত আমলে সেলিম প্রধানের সঙ্গে হাওয়া ভবনের অনেকের গভীর সম্পর্ক ছিল। সেলিমের বিয়ে নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনী। একসময় রাশিয়ার আনা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন সেলিম মিয়া। বর্তমানে জাপানেও তার এক স্ত্রী রয়েছে। পুরান ঢাকায় মাসুমা নামে এক নারীকেও বিয়ে করেন তিনি। তাকে নিয়েই গুলশানে থাকতেন তিনি। এ ছাড়া কাস্টমসে কর্মরত আরেক নারীকে সেলিম বিয়ে করেছেন বলে শোনা গেছে। সেলিম তার সাঙ্গোপাঙ্গদের মাধ্যমে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে গরু ও মাদক কারবারেও জড়িত ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে। অনেক সময় সংসদ সদস্য লেখা সংবলিত স্টিকারযুক্ত গাড়ি নিয়ে চলতেন তিনি। সিলেটের পাথর ব্যবসায়ও তার নিয়ন্ত্রণ ছিল। সেলিম প্রধান রূপালী ব্যাংকের তালিকায় অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি। ব্যাংকটি বর্তমানে তার কাছে পাবে শতকোটি টাকার বেশি।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেছেন, সেলিম প্রধান উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. ইয়াংসিক লির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো খুলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। আমরা এরই মধ্যে একটি গেটওয়েতে গত এক মাসে ৯ কোটি টাকা উত্তোলনের প্রমাণ পেয়েছি। তবে এই সিন্ডিকেটের আরও কোনো গেটওয়ে আছে কি না তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। অনলাইন ক্যাসিনোর বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, এটা ভার্চুয়াল ক্যাসিনো। অনলাইনে টাকা দিয়ে এগুলো খেলতে হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রেখে মোবাইলে সফটওয়্যার ইনস্টল করার পর (পি-২৪) ভিসা, মাস্টার কার্ড, বিকাশে রাখা অর্থ দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এটিতে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। কেউ টাকা জিতলে নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে টাকা আসবে। হারলে টাকাগুলো একটি গেটওয়ের মাধ্যমে তিনটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে যেত। সপ্তাহে একদিন সব টাকা এক ব্যাংকে দেওয়া হতো।
র্যাব-১ এর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম মিয়া জানিয়েছেন, ১৯৮৮ সালে ভাইয়ের মাধ্যমে জাপানে গিয়ে জাপানিদের সঙ্গে গাড়ির ব্যবসায় নিয়োজিত হন। পরে জাপানিদের সঙ্গে থাইল্যান্ড গিয়ে শিপ ব্রেকিং ব্যবসা করেন। পরে মি. দু নামের এক কোরীয় ব্যক্তি তাকে অনলাইন ক্যাসিনো খোলার উপদেশ দেন। এর ফলে তিনি ২০১৮ সালের পি-২৪ এবং টি-২১ হিসেবে দুটি গেমিং সাইট খোলেন। সেখান থেকে তিনি অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনা করতেন। তার কাগজপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, ওই কোরীয় ও সেলিমের ৫০-৫০ অনুপাতে মুনাফা ভাগাভাগির চুক্তি হয়েছিল।
র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে:কর্ণেল তানভীর মাহমুদ পাশা জানান, অপরাধীরো যতবড়ই শক্তিশালী হউক না কেন তাদের নজরদারি করছে আইনশৃংখলাবাহিনী। সাধারণ মানুষের কোন ক্ষতি সাধন হলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।