নির্বাচন নিয়ে বিএনপি কি মিশ্র বার্তা দিচ্ছে
টাচ নিউজ: নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চিন্তাধারা নিয়ে এখন আলোচনা জোরালো হচ্ছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির নেতাদের মধ্যে বক্তব্যে ‘ভিন্নতা’ দেখা যাচ্ছে।
এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ও দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্য।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অবিলম্বে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঠিক এর একদিন পরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকায় এক জনসভায় বক্তব্য দিয়েছেন।
তারেক রহমানের সে বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নির্বাচন নিয়ে কোনো তাড়াহুড়ো করা কিংবা ‘অবিলম্বে নির্বাচনের’ কোনো দাবি তোলেননি তিনি।
তারেক রহমান অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বললেও সেটি কবে নাগাদ করতে হবে সে সম্পর্কে কিছু বলেননি তিনি। একইসাথে তিনি সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি।
নির্বাচন নিয়ে বিএনপির বিভিন্ন নেতাদের বক্তব্যে ‘দোদুল্যমানতা’ দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক মুশতাক খান। তিনি মনে করেন, এই দোদুল্যমানতার দু’টি কারণ আছে।
মুশতাক খান বলেন, একদিকে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের নির্বাচনের চাহিদা, অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারের চাহিদা- এ দু’টি বিষয় মাথায় রেখে বিএনপি ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে।
‘বিএনপির অনেক কর্মী-সমর্থক আছে। তারা মনে করে একটা নির্বাচন হলে তাদের দল ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ আছে,’ বলেন মুশতাক খান।
কতদিন অপেক্ষা করবে বিএনপি?
বিএনপি মনে করছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন সেগুলো হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ ও বিচার বিভাগ।
তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন নিয়ে বিএনপি খুব একটা খুশি হতে পারছে না। তারা মনে করে, সংবিধান সংস্কারের কাজ নির্বাচিত সরকারের হাতে থাকতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। এসব কমিশন এখনো গঠিত হয়নি।
বিএনপি আশা করছে, এসব পুরোপুরি গঠনের কাজ শেষ করতে আরো মাসখানেক সময় লাগতে পারে। এরপর পরবর্তী তিন মাসে কমিশন তাদের রিপোর্টগুলো চূড়ান্ত করবে।
তারপর রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সেক্টরের মানুষের সাথে আলোচনা ও মতামত নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর প্রতিবেদন চূড়ান্ত হবে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এসব প্রক্রিয়া ছয়মাসের মধ্যে শেষ হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের জন্য খুব বেশি সময় লাগার কথা নয় বলে তারা মনে করেন।
‘ইটস্ ফেয়ার এনাফ। এর মধ্যে যদি আমরা প্রশ্ন করি যে এর মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করা যায় না? আমরা নির্ধারিত কোনো দিন বা মাসের কথা বলছি না,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ।
‘আপনারাও বুঝতে পারছেন এবং আমরাও বুঝতে পারছি যে কিছু সময় লাগবে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারে। যাতে আমরা বুঝতে পারব, কবে নাগাদ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ফিরে আসব। এই জিনিসটা আমরা চাই। তবে হার্ড অ্যান্ড ফাস্ট (ধরাবাঁধা) কোনো সময়ের কথা আমরা বলছি না,’ বলেন তিনি।
বিএনপি মনে করছে, প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় এখনো বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সুবিধাভোগীরা’ বহাল আছে।
‘আমরা বারবারই ওনাদের বলছি বিগত সরকারের সেট-আপ যত দ্রুত সম্ভব পাল্টানো দরকার,’ বলেন সালাউদ্দিন আহমেদ।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই মুহূর্তে নির্বাচনের জন্য বিএনপি যে খুব বেশি সিরিয়াস সেটি বলা যাবে না। কারণ নির্বাচনের সাথে নানা বিষয় জড়িত আছে।
‘বিএনপি হয়তো চাইবে যে অন্তত কিছুটা হলেও ভঙ্গুর অর্থনীতি ও প্রশাসনিক অবস্থা যাতে ঠিক হয়ে যায়। তারপর তারা হয়তো জেরালোভাবে দাবি করবে নির্বাচনের জন্য। কিন্তু একইসাথে তাদের নির্বাচনের কথা বলতে হবে। সেটা না হলে দল ধরে রাখতে পারবে না,’ বলছিলেন মুশতাক খান।
মিশ্র বক্তব্য কেন?
বিএনপি নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে তারা ‘সর্বোচ্চ সহযোগিতা’ করবে। একইসাথে বিএনপি বারবারই বলছে যে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দিতে চায়। কিন্তু এই যৌক্তিক সময় কতদিন হতে পারে সেটি পরিষ্কার করছে না দলটি।
বিএনপি চেয়ারপারসন তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের সারমর্ম অভিন্ন।
“দু’টি বক্তব্যের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই, হয়তো প্রাসঙ্গিকতার কারণে আপনার কাছে ভিন্ন মনে হচ্ছে,” বলেন মাহদী আমিন।
‘বিএনপি বারবার বলে আসছে যে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত একটা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা। এই যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং জনপ্রশাসনে যেসব সংস্কার আছে সেগুলো সম্পন্ন করা।’
গণতন্ত্র দিবসের জনসভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান বলেছেন, এই সরকারের ব্যর্থতা হবে গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। এটি প্রত্যেকের মনে রাখতে হবে। সুতরাং এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না।
অনেকে মনে করছেন, এ বক্তব্যের মাধ্যমে তারেক রহমান নির্বাচনের সময় নিয়ে নমনীয় মনোভাব পোষণ করেছেন। যদিও তার উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলছেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে তারেক রহমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
‘একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং রাজনৈতিক বন্দোবস্তে জনগণের অশিংদারিত্ব নিশ্চিত করার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এ কারণেই আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন বলেছেন তাদের ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না,’ বলছিলেন মাহদী আমিন।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, নির্বাচন নিয়ে বিএনপি আপাতত মাঝামাঝি অবস্থান বজায় রাখতে চায়। তারা একদিকে দেখাতে চায় যে সংস্কারের প্রতি তাদের সমর্থন আছে, অন্যদিকে নির্বাচন নিয়েও একটা চাপ বজায় রাখতে চায়।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়টি জনগণের আকাঙ্ক্ষা থেকেই তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সংস্কারের জন্য কোনো সুযোগ না দিয়ে সরাসরি নির্বাচনের দাবি তুলে ধরলে বিএনপির প্রতি জনগণের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
“তারা যদি বলে যে নির্বাচন দরকার নেই, সেটা তাদের অসুবিধা। আবার তারা যদি বলে এখনই নির্বাচন দিয়ে দিন তাতেও তাদের অসুবিধা। দু’টিই বিএনপির নেতৃত্বকে মাথায় রাখতে হবে,” বলছিলেন মুশতাক খান।
তিনি মনে করেন, “বিএনপিকে দুই পায়ে চলতে হবে। এক পায়ে তারা বলবে যে নির্বাচন দেন, নির্বাচন দেন। আরেকদিকে তারা একইসাথে বলবে যে সমস্যাগুলোর সমাধান করেন। এ দু’টি কথা বিএনপি বলতে থাকবে, এবং এটাই স্বাভাবিক।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের দিক থেকে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা হয় কী না, সেদিকেও দৃষ্টি রাখছে বিএনপি। এ বিষয়টিও নির্বাচনের সাথে সম্পৃক্ত। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বলছেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কোনো চিন্তা তাদের নেই।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে মির্জা ফখরুল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের মধ্য থেকে বলা হচ্ছে, নতুন দল তৈরি করতে হবে। নতুন দল তৈরি করার কথা বললে জনগণ কিভাবে বুঝবে তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছেন?
তবে বিষয়টি নিয়ে মির্জা ফখরুলের সাথে তারেক রহমানের বক্তব্যের ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।
‘কেউ যদি মনে করেন একটি উন্নত এবং নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য আরো নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে, তাতেও দোষের কিছু নেই। কারণ শেষ পর্যন্ত জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে সমর্থন জানাবে কিংবা কাকে সমর্থন দেবে না,’ বলেন তারেক রহমান।
তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলছেন, যেকোনো রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগকে বিএনপি স্বাগত জানায়।
‘এটিও মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে যেন কোনো রাজনৈতিক দলের জন্ম না হয় বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়,’ বলেন তিনি।
নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান দৃশ্যত বিপরীতমুখী। বিএনপির একসময়ের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীও দ্রুত নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।
কয়েক সপ্তাহ আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের সমালোচনা করে জামায়াতের আমীর শফিকুর রহমান বলেন, ‘এখনো শত শত মানুষ হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। রক্তের দাগ মোছেনি। বন্যায় দেশ আক্রান্ত। এই সময়ে কেউ নির্বাচন নির্বাচন জিকির তুললে জাতি তা গ্রহণ করবে না।’
জামায়াত নেতার এই বক্তব্য ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি। পরে এর জবাবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘যাদের জনসমর্থন নেই, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করে, আমি কোনো দলের নাম বলছি না। যাদের ভোটে জয়ের সামর্থ্য নেই, তারাই নির্বাচনের বিরুদ্ধে।’