মহানবীর (সা): আদর্শ জীবন
টাচ নিউজ: মহান আল্লাহ পথহারা মানবকুলকে পথের দিশা দেয়ার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রেরণ করেন সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:কে। তিনি এসে আল্লাহর দীক্ষা আর কুরআনি শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন গোটা বিশ্বকে।
মুসলমানদের মধ্যে, বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশে অবস্থানরত মুসলমানদের মধ্যে মহানবী সা:-এর জন্মের দিনটির ভাবগাম্ভীর্য অনেক বেশি। আর মানবতার মুক্তির দিশারী সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: সারা জাহানের হিদায়েতের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন, ‘আমি তোমাকে প্রেরণ করেছি বিশ্বজগতের জন্য বিশেষ রহমতস্বরূপ।’
মহানবী সা:-এর জন্মের পূর্বে সমাজ চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, পাপাচার, দুরাচার, ব্যভিচার, মিথ্যা, হত্যা, লুণ্ঠন, মদ্যপান, জুয়ায় ভরপুর ছিল। অন্যায়-অপরাধ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, নৈরাশ্য আর হাহাকার বিরাজ করছিল। ঠিক এমন সময় মানবতার মুক্তির দিশারী সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: সারা জাহানের হিদায়াতের জন্য আবির্ভূত হলেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয় : হজরত মুহাম্মদ সা: বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রের বনি হাশিম বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আব্দুল্লাহ, মায়ের নাম আমিনা।
হজরত মুহাম্মদ সা: ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। এ ছাড়া জন্মতারিখ নিয়ে মতানৈক্য পাওয়া যায়, যেমন-ইবনে খালদুনের মতে, ১২ রবিউল আওয়াল (সিরাতে সাইয়্যিদুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা ১১৭)। অনেকের মতে, ৯ রবিউল আউয়াল সোমবার রাসূলুল্লাহ সা:-এর জন্মদিন। (কাসাসুল কোরআন, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৫৩)। ইবনে কাসিরের মতে, ১৮ রবিউল আউয়াল (আলবিদা ওয়ান নিহায়া, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪২)। আবু মাশার নাজিহের মতে, ২ রবিউল আউয়াল (তাবাকাতে ইবনু সা’দ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮০)।
সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, রাসূল সা: রবিউল আউয়াল মাসের সোমবারে জন্মগ্রহণ করেন, এ ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য নেই। আর সেটি ছিল ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে। এই সোমবার ৮ অথবা ৯ কিংবা ১২ এটুকুতেই হিসাবের পার্থক্য আছে মাত্র।
রাসূল সা: ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখেই ইন্তেকাল করেছেন মর্মে অসংখ্য উদ্ধৃতি আছে। (আর-রওদুল উন্ফ : ৪/৪৩৯-৪৪০, আস-সিরাহ আন-নববিয়্যাহ : ৪/৫০৯, ফাতহুল বারি : ৮/১৩০) জন্মের পূর্বে পিতাকে হারান। সর্বপ্রথম তাঁকে তাঁর মাতা হজরত আমেনা দুগ্ধ পান করান। এরপর আবু লাহাবের বাঁদী ‘সুওয়াইবা’ তাকে দুগ্ধ পান করান। তারপর ধাত্রীর সন্ধান করতে থাকেন। ‘হাওয়াযিন’ গোত্রের বনি সা’দ এর মহিলা হালিমা ছা’দিয়া এই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হন। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত হজরত মুহাম্মদ সা: বনি সা’দে লালিত পালিত হন। ৬ বছর বয়সে তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেন। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তিনি এতিম হয়ে যান। তাকে লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন দাদা আবদুল মুত্তালিব। আট বছর বয়সে দাদাকে হারালে চাচা আবু তালেব তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
খ্রিষ্টান পাদ্রী বহিরার ভবিষ্যৎবাণী : আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মাদের বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। প্রগাঢ় মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেন না। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। কথিত আছে, শহরটিতে জারজিস নামে এক খ্রিষ্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গির্জা থেকে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারি করেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন।
হিলফুল ফুজুল : আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানতপ্রবণতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমনের তরুণ বয়সে মুহাম্মদ সা: একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যার নাম ছিল হিলফুল ফুজুল। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিয়ে : হজরত মুহাম্মদ সা: ব্যবসায় উপলক্ষে সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। মুহাম্মাদের সুখ্যাতি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ তা অবহিত হয়েই তাকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাওয়ার অনুরোধ জানান। মুহাম্মাদ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদিজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান। খাদিজা মাইছারার মুখে মুহাম্মাদের সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভূয়সী প্রশংসা শুনে অভিভূত হন। এ ছাড়া ব্যবসায়ের সফলতা দেখে তিনি তার যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হন। একপর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। খাদিজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মদের বয়স ছিল ২৫। খাদিজা স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহের কাছে বিয়ের ব্যাপারে তাঁর মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে শুনে মুহাম্মদ বলেন যে, তিনি তাঁর অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানাবেন। মুহাম্মদ তাঁর চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য : ছোটবেলা থেকেই তিনি সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। লোকেরা তাকে আলআমিন বলে ডাকত। আলআমিন অর্থ হচ্ছে বিশ্বাসী। মক্কাবাসী তখন তার কাছে নিজেদের মালামাল আমানত রাখত। একটি ঘটনা বর্ণনা করা যাক, নবী সা:-এর বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কাবাগৃহ পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন পড়ে। কাবা গৃহের সংস্কারকাজ শুরু হলে নির্মাণ কাজ সব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ছিল একজনের কাজ। কোন গোত্রের লোক এই মহৎ কাজটি করবে তা নিয়ে কোন্দল শুরু হয়ে যায়। চার-পাঁচ দিন যাবৎ এ বিবাদ অব্যাহত থাকার একপর্যায়ে এটি এমনই মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটার আশঙ্কা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় আবু উমাইয়া মাখজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করে যে, পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যে প্রথম প্রবেশ করবে তার সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেবে। পরদিন মুহাম্মদ সা: সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেন। এতে সবাই বেশ সন্তুষ্ট হন এবং তাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেন। আর তার প্রতি সবার সুগভীর আস্থাও ছিল। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনী। যা হোক এই দায়িত্ব পেয়ে মুহাম্মাদ সা: অত্যন্ত সুচারুভাবে ফয়সালা করেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার ওপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং বিবদমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোনা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন এবং তারা তাই করে। এরপর তিনি পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন।
নবুওয়তপ্রাপ্তি : বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তিনি বেশি বেশি দান করতে থাকেন। এ সময় তিনি হেরা গুহায় একটানা দুই-তিন দিন কাটিয়ে দেন। এমনি এক ধ্যানের সময় ফেরেশতা জিব্রাইল তার কাছে আল্লাহ প্রেরিত অহি নিয়ে আসেন। জিব্রাইল তাঁকে এই পঙ্ক্তি ক’টি পড়তে বলেন : ‘পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’
ইসলামের দাওয়াত : হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনীতে পাওয়া যায় তিনি তিন বছর গোপনে দান করতে থাকেন। এ সময় তিনি তার কাছের মানুষদের ইসলামের ছায়ায় নিয়ে আসেন। নবী সাফা পর্বতের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সবাইকে সমবেত করেন। এরপর প্রকাশ্যে বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। কিন্তু এতে সবাই তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড খেপে যায় এবং এই সময় থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার শুরু হয়। উমর ইবনুল খাত্তাব এবং চাচা হামযা ইসলাম গ্রহণ করবে ইসলাম প্রচার করা মহানবী সা:-এর জন্য কিছুটা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু সাথে সাথে মক্কার কুরাইশদের ষড়যন্ত্র বেড়ে যায়।
হিজরত : মদিনার বেশ কিছু লোক ইসলামের প্রতি উৎসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা মূলত হজ করতে এসে ইসলামে দাওয়াত পেয়েছিল। একসময় মদিনার ১২টি গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণের মাধ্যমে মুহাম্মদ সা:কে মদিনায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। মক্কার কুরাইশদের অত্যাচার যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে তখন ধীরে ধীরে মক্কার মুসলমানরা মদিনায় হিজরত করে। সবশেষে মুহাম্মদ ও আবু বকর ৬২২ সালে মদিনায় হিজরত করেন।
স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা : মুহাম্মদ মদিনায় গিয়েছিলেন একজন মধ্যস্থতাকারী এবং শাসক হিসেবে। মদিনার সব গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদিনা সনদ স্বাক্ষর করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এই সনদের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে সব রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির গোড়াপত্তন করা হয় এবং সব গোত্রের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়। এই সনদের মাধ্যমে মদিনা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুহাম্মদ সা: হন তার প্রধান।
হুদাইবিয়ার সন্ধি : কুরাইশদের শত্রুতার কারণে মুসলিমরা হজ আদায় করতে পারছিল না। মুহাম্মদ সা: হজ করার জন্য মনস্থির করেন এবং ৬ হিজরি সনের শাওয়াল মাসে হজের উদ্দেশ্যে ১৪০০ সাহাবা নিয়ে মদিনার পথে যাত্রা করেন। কিন্তু এবারো কুরাইশরা বাধা দেয়। মুসলিমরা মক্কার উপকণ্ঠে হুদাইবিয়া নামক স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করেন। এখানে কুরাইশদের সাথে মুসলিমদের একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে সুপরিচিত।