ঢাকা | ডিসেম্বর ২১, ২০২৪ - ১২:০৬ অপরাহ্ন

শিরোনাম

সামাজিক অবক্ষয় ও আমাদের করণীয়

  • আপডেট: Wednesday, May 17, 2023 - 6:25 pm
  • পঠিত হয়েছে: 681 বার

মনিরুল ইসলাম রোহান
সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে আলোচনা করার আগে ‘সমাজ’ ও ‘অবক্ষয়’ শব্দ দুটির আলাদা ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। শহর বা গ্রামে যেখানেই বসবাস করি না কেন এই শব্দটির সাথে আমরা বেশ পরিচিত। কারণ প্রত্যেকেই আমরা সমাজেরই অংশ। তাই সমাজ কাকে বলে বা সমাজ কি এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করছি।
সমাজ বলতে মূলত এমন এক ব্যবস্থা বোঝায়, যেখানে একাধিক চরিত্র একত্রে কিছু নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করে একত্রে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলে। মানুষের ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তি একত্র হয়ে লিখিত কিংবা অলিখিত নিয়ম-কানুন তৈরি করে; এরকম একত্র বসবাসের অবস্থাকে সমাজ বলে। মার্কিন সমাজ বিজ্ঞানী রবার্ট মরিসন ম্যাকাইভার এর মতে, ‘সমাজ মানুষের বহুবিধ সম্পর্কের এক বিচিত্র রূপ’। আর সমাজ বিজ্ঞানী গিডিংস এর মতে, ‘সমাজ বলতে আমরা সেই জনসাধারণকে বুঝি যারা সংঘবদ্ধভাবে কোনো সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিলিত হয়েছে’।
এবার আসি ‘অবক্ষয়’ বলতে আমরা কি বুঝি। অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’। এছাড়াও পতন, অধ:পতন, ধ্বংস করা, বিনাশ করা প্রভৃতিও বোঝায়। সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য পরায়নতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যাবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে সামাজিক অবক্ষয়।
আজকে আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখতে পাই পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয়ের ছাপ। নৈতিক মূল্যবোধগুলো অনেকটা হারিয়ে গেছে। সমাজে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। আজকের যুব সমাজ একটা ঘোরের মধ্যে আছে। হাতের নাগালে এসেছে মদ, গাজা, ইয়াবাসহ নেশা জাতীয় নানা উপাদান। যুব সমাজের একটি বড় অংশ অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে সমাজে খুন হত্যা ধর্ষণসহ নানা অপরাধ অহরহ সংঘটিত হচ্ছে, পারিবারিক কলহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অবাধ যৌনাচার, অশ্লীলতা, কুরুচিপূর্ণ সমকামী ও বহুকামিতার মতো পশুসুলভ যৌন আচরণ সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে অবক্ষয়ের দ্ধারপ্রান্তে। মুঠোফোনের সহজলভ্যতা যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করেছে তেমনি এর অপব্যবহারের ফলে ছোট্ট শিশু ও যুব সমাজ ভিন্ন দিকে ধাবিত হচ্ছে।
খবরের পাতা খুললেই দেশের কোথাও না কোথাও সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র চোখে পড়ে। পত্রিকা পাতা খুললেই চোখে পড়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, প্রেমিকার হাতে প্রেমিক খুন, প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা খুন, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, ছেলের হাতে মা খুন, দুলা ভাইয়ের হাতে শালী খুন, পুত্রের হাতে পিতা খুন ইত্যাদি ইত্যাদি। জমি জমা ভিটে মাটি নিয়েও খুন হত্যা হচ্ছে। আবার পরকীয়ার বলি হচ্ছে ছোট্ট শিশুটি। রাস্তাঘাটে বের হলেই নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, বখাটেরা করছে উত্যক্ত। কোথাও কোথাও হায়েনার মতো লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে ঝাপিয়ে নারীর ওপর নরপিশাচরা। সর্বোস্ব খুইয়ে লোকলজ্জার ভয়ে নারী করছে আত্মহত্যা। বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের খবর দেশের সর্বত্রই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এসব মূলত মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ না থাকা এবং সামাজিক অধপতনের কারণে হয়ে থাকে।
২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে কু প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় স্বামীকে আটকে রেখে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্মম নির্যাতন চালায় এবং ভিডিও চিত্র ধারণ করে দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার ও তার সহযোগিরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই নারীর নগ্ন ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এর পরের মাসে এক গভীর রাতে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে এক বিধবা নারীকে দলবেঁধে গণধর্ষণ করে হাত-পা ও চোখ-মুখ বেঁধে ঘরের পেছনে ফেলে পালিয়ে যায় এলাকার বখাটেরা। একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় হাসপাতাল থেকে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে দশম শ্রেণীর ছাত্রী নিলা রায়কে চাকু মেরে হত্যা করে সাভারের বখাটে যুবক মিজান। সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে ছাত্রলীগ নামধারী বখাটেরা। ঘটনাটি ঘটে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে। এসব ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। চলতি মাসের ৩ তারিখে নেত্রকোণা উপজেলার বারহাট্টা উপজেলার প্রেমনগর ছালিপুরা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী মুক্তি বর্মণকে স্কুল থেকে ফেরার পথে একই গ্রামের কাউছার মিয়া প্রকাশ্যে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। শুধু সিলেটের এমসি কলেজ, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, নেত্রকোণার বারহাট্টা, জয়পুরহাট কিংবা লক্ষীপুরের রামগতি নয়, সারাদেশে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল হলেই কেবল নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। অধিকাংশ ঘটনাই প্রভাবশালীদের নানা হুমকি ধামকি ও ভয়ভীতি দেখানোর কারণে এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুক্তভোগীরা প্রকাশ করতে সাহস পায় না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র -আসকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে শিশু নির্যাতন হয়েছে ২৮০ জন। এরমধ্যে থানায় কেস ফাইল হয়েছে ১২৬টি। আর ১৫৮জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। যার মধ্যে কেস ফাইল হয়েছে ৬২টি। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত গত চার মাসে ১৭৭জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৫জনকে। এছাড়াও ৪৬জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। আর অর্ধশতাধিক নারীকে যৌন হয়রানি করা হয়েছে। এগুলোতো কেবল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তার বিবরণ। কিন্তু এর বাইরেও কত ঘটনা আছে যেগুলো আমাদের তথ্যের বাইরে এবং ওই সকল ঘটনার খবর আসলে আমরা জানি না। তারপরও এই চিত্র আমাদের সমাজের জন্য ভয়াবহ। এসব চিত্র বলে দেয় সামাজিক অবক্ষয় আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে।
সামাজিক অবক্ষয়রোধে আমাদের করণীয়: প্রথমত: পারিবারিকভাবে সচেতনতা তৈরি করা। যারা অপরাধগুলো করছে তারা কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। পারিবারিকভাবে আমাদের সচেতন হতে হবে। পরিবারের কোনো সদস্য যেন অন্য কারো ক্ষতি না করে, সমাজের কোনো অনিষ্টসাধন না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখতে হবে। সেটা ছোট হোক কিংবা বড়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের পারিবারিক নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা তৈরি করা। অপরাধ করলে শাস্তির বিধান ও ক্ষতিকর দিকগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে তুলে ধরা। সকলেই যাতে জানতে পারে কোন কোন অপরাধে কি শাস্তি রয়েছে। তাছাড়া অপরাধীকে কোনোভাবেই ছাড় না দেয়া। একজন অপরাধী যদি অপরাধ করে, খারাপ কাজ করে পার পেয়ে যায় তাহলে অন্য অপরাধীরাও উৎসাহিত হয়। যতই প্রভাবশালী হোক অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তৃতীয়ত: সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। সামাজিক অবক্ষয়রোধে সামাজিক আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চতুর্থত: নৈতিক শিক্ষা চালু করা। সামাজিক অবক্ষয়রোধে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে থাকে।
তাছাড়া একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনগোষ্ঠী বড় হয়ে কি করবে বা না করবে, তাদের আচার-আচরণ কেমন হবে? এসব কিছু নির্ধারণ করে তারা কোন সমাজে বড় হচ্ছে। তাই প্রত্যেকের উচিত তাদের বসবাসরত সমাজকে একটি আদর্শ সমাজ হিসেবে গড়ে তোলা। আমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো আমাদের বসবাসরত সমাজকে একটি আদর্শসমাজ হিসেবে পরিণত করা। আর একটি আদর্শসমাজ পরিণত করতে হলে আমাদের প্রত্যেকের মৌলিক দায়িত্ব হওয়া উচিত সর্বপ্রথম নিজেকে একজন আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে গঠন করা। কেননা ব্যক্তি গঠনই হলো একটি আদর্শসমাজ গঠনের মূল হাতিয়ার। আসুন আমরা সবাই মিলে একটি আদর্শ সমাজ গঠনে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখি। তাহলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ বিশ্লেষক।