দৈনিক হাজিরার নিয়োগ নিয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ‘নয়ছয়’
টাচ নিউজ ডেস্ক:জনবল স্বল্পতার কারণে বিভিন্ন সময়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে বা মাস্টাররোলে নিয়োগ দেয়া হয়। এসব নিয়োগের সরকারি কোনও নীতিমালা না থাকায় বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী নিয়োগ দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত বছর বোর্ডের পক্ষ থেকে এ ধরনের নিয়োগের কিছু নির্দেশনা জারি করেছিল বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খান। কিন্তু খোদ চেয়ারম্যান এবং সচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে নিজেদের নীতিমালা ভেঙে নিয়োগ দিয়েছেন তারা।
এসব নিয়োগের জন্য দীর্ঘদিন ধরে মাস্টাররোলে কাজ করে আসা কর্মচারীদেরও ছাঁটাই করা হয়েছে। নীতিমালায় ৩০ বছরের বেশি বয়সের জনবল নিয়োগের কথা বলা হলেও অধিকাংশ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৩০ এর নিচে। এমনকি, সরকারি নীতিমালায় দৈনিক হাজিরার কেউ সরকারি আবাসন সুবিধা পান না। কিন্তু নিজেদের পছন্দের চুক্তিভিত্তিক কোনও স্টাফকে কোয়ার্টার দেওয়ারও ঘটনা ঘটেছে।
২০২২ সালের ৬ মার্চের (স্মারক নং ৫৭.১৭.০০০০.১০২.১৮.০১৬.১৭.১৬৩) এক বিজ্ঞপ্তির অনুচ্ছেদ-৬ এ বলা হয়, ৩০ এর কম এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে বয়সীদের দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। অথচ, নিয়ম না মেনে বোর্ডে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে ২০-২৫ জন লোক নিয়োগ দিয়েছেন। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ, এসব নিয়োগে কোটি টাকা বাণিজ্য হয়েছে।
এই অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, দৈনিক হাজিরা নিয়োজিত জনবলের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে ৩ মাসের বেশি কাজ করানো যাবে না। কিন্তু নিজেদের পছন্দের কিছু প্রার্থী সাত মাস ধরে কাজ করছেন। অভিযোগ রয়েছে, অনুচ্ছেদের অর্ধেক নিয়মকে পুঁজি করে এবং নতুন ধারা সংযোজন করে আগের লোকদের বদলে এসব নতুন নিয়োগ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খান দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে নিয়োজিত তার আত্মীয়-স্বজনদের কাজে লাগানোর জন্য গত বছরই মাস্টাররোলে নিয়োজিত ১১ জনকে মামলার অজুহাতে বোর্ড থেকে বের করে দেন। এসব পদের বিপরীতে চেয়ারম্যান এবং বোর্ডে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত মাস্টাররোলে নতুন লোক নিয়োজিত করছেন। অন্যদিকে, পুরাতন অভিজ্ঞ দৈনিক হাজিরাভিত্তিক লোকদের তাদের দীর্ঘদিনের চাকরি চেয়ারম্যানের মৌখিক আদেশে তাৎক্ষণিক বের করে দেওয়া হয়, যা মানবতাবিরোধীর শামিল।
দৈনিক হাজিরাভিত্তিক ডিপ্লোমা শাখায় কর্মরত ছিলেন সুমী আক্তার নামে একজন। তিনি ১৬ বছর ধরে কর্মরত ছিলেন। কিছুদিন আগে তাকে না করা হয়, তাৎক্ষণিকভাবে তার পরিবর্তে ৪ জন লোক নিয়োগ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত রয়েছেন। যার প্রমাণ তদন্ত কমিটি করলে বের হয়ে আসবে। বোর্ড চেয়ারম্যানের মূল উদ্দেশ্যই হলো, পুরাতন অভিজ্ঞ দৈনিক হাজিরাভিত্তিক লোকদের বের করে নতুন লোক নিয়োগ করে বিশাল অংকের ‘বাণিজ্য’ করা।
সূত্রের খবর, চেয়ারম্যান আলী আকবর খান দৈনিক হাজিরাভিত্তিতে নিয়োজিত তার এক নিকটাত্মীয় ড্রাইভার মো. আবু সাইদসহ আরও দুই জনকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা (বাসা বরাদ্দ, ওভারটাইম, সাপোর্ট সার্ভিসের সম্মানী বাবদ প্রায় ৭০-৮০ হাজার টাকা) প্রদান করছেন, যা বোর্ডের তহবিল তসরুপের শামিল। অন্যদিকে বোর্ডের অন্যান্য দৈনিক হাজিরাভিত্তিতে নিয়োজিত জনবল মাসে ১৪-১৫ হাজার টাকা পান, যা চরম বৈষম্যের শামিল।
আরও অভিযোগ, ড্রাইভার আবু সাইদের মেয়ে উর্মি আক্তারকে অফিস সহকারীর চাকরি দেওয়ার লক্ষে ইতোমধ্যে মাস্টাররোলে নিয়োজিত করেছেন চেয়ারম্যান। অভিযোগ উঠেছে, এই নিয়োগের জন্য ১৫ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে।
সূত্রে খবর চেয়ারম্যানের বিদেশে থাকা অবস্থায় বোর্ডের মিটিং এর সম্মানে নিয়ে থাকেন যেটা সম্পূর্ণ বেআইনি. প্রত্যেকদিন বোর্ডের মিটিংয়ে নামে চেয়ারম্যান চারটা পাঁচটা মিটিং করে থাকেন একই সময় দৈনিক ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন যেটা সম্পূর্ণ অবৈধ বেআইনি.
বোর্ডের কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক একজন সভাপতি জানান, ড্রাইভার আবু সাইদ মাস্টাররোলে কর্মচারী। সে বোর্ডে কোয়ার্টার পেতে পারে না। অথচ এখনও পর্যন্ত স্থায়ী অনেক কর্মচারী কোয়ার্টার পায়নি।
তিনি বলেন, চেয়ারম্যান কোটি টাকার নিয়োগ-বাণিজ্য করতে আরও অফিসার ও কর্মচারী প্রায় ৪০টি পদে শিগগিরই নিয়োগ দেওয়ার জন্য পাঁয়তারা করছেন। অথচ বোর্ডে বর্তমানে কর্মকর্তার সংখ্যা ৭৬, কর্মচারী ৫৮ জন। বোর্ডে সিবিটি সেল এনএসডিসিআই নিয়ে যাবে বলে জোর গুঞ্জন চলছে, কিন্তু সিবিটি সেলের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া আছে। পরিচালক (আইসিটি)-১ জন, উপ-পরিচালক (কোর্স অ্যাক্রিডিটেশন) ১ জন। উপ-পরিচালক (এলএমডি) ১ জন, ইন্ডা. লিয়াজোঁ অফিসার ২ জন, বিশেষজ্ঞ (এলএমডি) ১ জন, সহবিশেষজ্ঞ (কোর্স অ্যাক্রিডিটেশন) ১ জন। মোট ১৬টি পদের লোক নিয়োজিত। সিবিটি সেল নিয়ে যাওয়ার পর এসব পদে লোকগুলো কোনও কাজই থাকবে না। ইতোমধ্যে শর্ট কোর্সও নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু অসাধু কর্মকর্তা এনএসডিসিআই সাথে লিয়াজোঁ করে আসছে। শর্ট কোর্স চলে গেলে আরও ২জন কর্মকর্তা ও ২ জন কর্মচারীর কোনও কাজ থাকবে না। অর্থ মন্ত্রণালয় হতে বোর্ডের উদ্বৃত্ত তহবিল জমা দেওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। বোর্ডের এই ক্রান্তিলগ্নে আর ৪০ জন লোক নিয়োগ দিলে বোর্ড মুখ থুবড়ে পড়বে। সাধারণ নিয়মে সর্বদা কর্মকর্তা কম থাকে এবং কর্মচারী বেশি থাকে। কিন্তু বোর্ডে তার উল্টো। আবার আরও ২২ জন কর্মকর্তা ও ১৮ জন্য কর্মচারী মোট ৪০ জন লোক নিয়োগের জোর প্রক্রিয়া চলছে। আরো জানায় যায় যে নবম গ্রেডের তার ছেলেকে চাকরি দিবে কিন্তু নিয়োগ কমিটিদের চেয়ারম্যান সদস্য আছে এটা বেআইনি . বোর্ডের কোয়ার্টারের ব্যবহৃত গ্যাসের লাইন চেয়ারম্যান টাকার বিনিময়ে বোর্ড ক্যান্টিনে সংযোগ দিয়েছে যা এটা সম্পূর্ণ বেআইনি।
যাদের দৈনিক হাজিরাভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছে তারা হলো- মো. রাসেল, সাফিয়া খাতুন, সঞ্জয় কুমার পাল, শহিদুল ইসলাম, শাহনাজ, মোসাম্মৎ লাবনী আক্তার, মানিক মিয়া, মোসা. উর্মি, তারেক আজিজ, শফিকুল ইসলাম, শামিমা আক্তার, আল মাহমুদ, আমির হোসেন, মনির, জাকির, রিয়াজ, মো. বাদল, শামিমা জামান, আরিফুল, আসলামসহ আরও অনেকে।
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ রজব আলী বলেন, এসব অবৈধভাবে লোক নিয়োগ দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি কারণ তারাই আইন তৈরি করেছেন আবার তারা আইন ভঙ্গ করে জনবল নিয়োগ দিয়েছেন অবৈধভাবে। যেহেতু চেয়ারম্যান নতুন আইন তৈরি করেছেন ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে এবং ৬৫ বছরের নিচে জনবল নিয়োগ দিতে পারবেন, তাহলে তারা আইন ভঙ্গ করে ৩০ বছরের নিচে জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি।
তিনি আরও বলেন, চেয়ারম্যান নবম গ্রেডের নিয়োগ দেওয়ার জন্য পাঁয়তারা করছেন। যদি নবম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে বোর্ড অফিসের লোকেরা ওই পোস্টের বিপরীতে প্রমোশন পাবেন না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খানকে কয়েকবার ফোন দিলেই তিনি সাড়া দেননি।
তবে শিক্ষা বোর্ডের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান পুরো বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমি এই বোর্ডে দুই বছরের মতো সময় ধরে আছি। এখন সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ। সাময়িক যেসব নিয়োগ দেওয়া হয় সর্বোচ্চ এক মাসের জন্য।
দৈনিক হাজিরার অনেকে ৭ মাস ধরেও বোর্ডে কাজ করছে এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন পরীক্ষার পর এই সাময়িক নিয়োগগুলো দেয়া হয়। অল্প কিছুদিন তারা কাজ করে।