ঢাকা | ডিসেম্বর ২১, ২০২৪ - ১০:২০ অপরাহ্ন

শিরোনাম

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়গাথা

  • আপডেট: Sunday, December 18, 2022 - 11:42 am
  • পঠিত হয়েছে: 168 বার

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিতপ্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের আহ্বানেবাংলা প্রদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলিম লীগেরপক্ষে রায় দেয়। নির্বাচনে ১১৯টি আসনের মধ্যে১১৪টি লাভ করে মুসলিম লীগ। এ নির্বাচনেরফলাফলকে পাকিস্তানের পক্ষে বঙ্গীয় মুসলমানদেরঐতিহাসিক রায় হিসেবে ধরা হয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পূর্ব বাংলারজনগণের অবদান বেশি থাকা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালেপাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসনক্ষমতা চলে যায়প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। পূর্বপাকিস্তান থেকেও যারা রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার ছিলেনতারাও বাঙালির স্বার্থ রক্ষায় মনোযোগী ছিলেন না।মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রগতিশীল যুব ওছাত্রনেতারা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার মানুষেরআত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ১৯৪৮সাল থেকেই তত্পর ছিলেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তথা মাতৃভাষারমর্যাদা রক্ষার লড়াই ছিল প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতিরমুক্তি ও স্বাধীনতার প্রথম সোপান। বায়ান্নর পথ ধরেচুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেবাঙালি ঐক্যবদ্ধভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদেরএকচ্ছত্র শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবেআবির্ভূত হন। তারই আহ্বানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনেছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানেরতথা বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রায় দেয়। বঙ্গবন্ধুরআওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানেরজন্য বরাদ্দকৃত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতেবিজয়ী হয়। পাকিস্তানের ৩১৫ আসনের জাতীয়পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকরে সরকার গঠনের দাবিদার হয়।

কিন্তু কতিপয় পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীলরাজনীতিবিদের প্ররোচনায় সামরিক সরকারআওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। এরপ্রতিবাদে বাঙালি আন্দোলনে নামলে পাকিস্তানিশাসকরা বলপ্রয়োগে তা দমনের চেষ্টা করে। ১৯৭১সালের ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী আন্দোলনেবহু বাঙালির রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় ঘোষণাকরেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানি সামরিকসরকার ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে ঢাকাসহবিভিন্ন বড় বড় শহরে গণহত্যা শুরু করে। এরইপ্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুররহমান বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণাকরেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ইপিআরেরওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র প্রচারিত হয়।তারই আহ্বানে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ।

পাকিস্তানি সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারকরে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠসহচর তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামপ্রমুখের নেতৃত্বে ১০ এপ্রিল ভারতের কলকাতায়বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিলকুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার ভবের পাড়ায়(বৈদ্যনাথতলা) আমবাগানে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানেবাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে। শপথগ্রহণের ওই স্থানটির নাম রাখা হয় মুজিবনগর।প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা দেন, অস্থায়ীরাজধানী মুজিবনগর থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনাকরা হবে। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরঅনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ীরাষ্ট্রপতি হন। মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য ছিলেনক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদও এএইচএম কামারুজ্জামান। কর্নেল (অব.) এমএজিওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধীর সরকার সর্বতোভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়েদেয়। ভারতের নিয়মিত সেনাবাহিনীর মাধ্যমেবাংলাদেশ থেকে আসা ছাত্র-যুবক-জনতাকেমুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়াহয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাচার ওহত্যাযজ্ঞের কারণে ভীত হয়ে প্রায় এক কোটি বাঙালিভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়।

২৬ মার্চ থেকেই সাবেক পূর্ব পাকিস্তানেঅবস্থানকারী বাঙালি সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীঅফিসার ও জওয়ান, ইপিআরের সদস্য ও প্রতিরক্ষাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যুদ্ধে অংশনেন। তারা প্রাথমিক অবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহকরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেওসংগঠিত ও সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পেরেওঠা সম্ভব ছিল না। সেজন্য এপ্রিলের মধ্যে তারাভারতে আশ্রয় নেন এবং ভারত থেকে মুক্তিযুদ্ধচালিয়ে যান। উপরন্তু দলে দলে বাঙালি ছাত্র, যুবক ওজনতা ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে অংশ নেন। শুধুতা-ই নয়, সর্বস্তরের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগনেতারা এবং (মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীব্যতীত) অন্যান্য দল যেমন—মওলানা ভাসানীরন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), মস্কোপন্থী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টিও ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বাবাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিভিন্ন সাংগঠনিককাজে অংশ নেয়।

অস্থায়ী সরকার গঠনের পর কর্নেল (অব.) আতাউল গনি ওসমানীকে জেনারেল পদে উন্নীতকরে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়এবং তার অধীনে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী এবংইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীরসদস্যদের ন্যস্ত করা হয়। সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনারজন্য সমগ্র বাংলাদেশের রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগকরা হয়। সেক্টর কমান্ডারদের এলাকা ভাগ করে দেয়াছাড়াও তিনজন সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে তিনটিবাহিনী গঠন করা হয়। যেমন—মেজর সফিউল্লাহরনেতৃত্বে এস-ফোর্স (৩ নং সেক্টর), মেজর জিয়াউররহমানের নেতৃত্বে জেড-ফোর্স (১ নং সেক্টর) এবংমেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কে-ফোর্স (২নং সেক্টর)। অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডর ছিলেনমেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত (সিলেট, হবিগঞ্জ, ৪ নং সেক্টর), মেজর মীর শওকত আলী (৫ নং সেক্টর), উইংকমান্ডার এমকে বাসার (রংপুর ও দিনাজপুরেরএকাংশ, ৬ নং সেক্টর), কর্নেল নুরুজ্জামান(দিনাজপুরের একাংশ, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া, ৭নং সেক্টর), মেজর উসমান চৌধুরী ও পরে মেজরমঞ্জুর (কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনার একাংশ, ৮ নংসেক্টর), মেজর এমএ জলিল (খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ফরিদপুরের একাংশ, ৯ নং সেক্টর), নৌবাহিনীর নৌ-কমান্ডো সমগ্র বাংলাদেশের নদী ওসমুদ্র মেজর আবু তাহের (১১ নং সেক্টর), উইংকমান্ডার হামিদুল্লাহ (ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ১১ নংসেক্টর)।

এসব সেক্টর কমান্ডারের অধীনে নিয়মিত প্রতিরক্ষাবাহিনী, পুলিশ, আনসারসহ ছাত্র, তরুণ, কৃষক, শ্রমিক সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে। তাদেরবলা হতো মুক্তিবাহিনী। কখনো কখনো মুক্তিবাহিনীদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি, পাহারারত স্থান বা রণাঙ্গনে নিয়োজিত পাকিস্তানিসৈন্যদের গেরিলা কায়দায় আক্রমণ ও হতাহত করেনিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেত। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিসৈন্যদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করার জন্যগুরুত্বপূর্ণ সেতু, স্থাপনা ইত্যাদি বোমা মেরে ধ্বংসকরে দিত। সরকারি নেতাদের ভাষণ, যুদ্ধের খবরপ্রচার ও গণসংগীতের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী ওদেশবাসীকে উজ্জীবিত রাখার জন্য ছিল ‘স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র’। বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেনি তারামুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, আহার ও অর্থ দিয়ে সহায়তাকরত। গ্রামের পর গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সবারসহায়তায় যুদ্ধ করতেন। পাকিস্তানি সরকার বাবাহিনীকে সহায়তাকারীরা ‘দালাল’রূপে চিহ্নিত হয়।তারা ‘শান্তি কমিটি’ ও ‘রাজাকার বাহিনী’ গঠন করে।তবে এদের সংখ্যা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের জনগণেরতুলনায় অতি নগণ্য। তাদের সহায়তায় পাকিস্তানিসেনারা কখনো কখনো বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মুক্তিসেনাদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়দের এবং নিরীহগ্রামবাসীকে হত্যা ও ক্ষতি করত এবং বাড়িঘরজ্বালিয়ে দিত। যাকে সন্দেহ করত, তাকেই হত্যাকরত। পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে গণহত্যারপাশাপাশি বাঙালি মা-বোনদের ধর্ষণ ও নির্যাতনকরত।

বিদেশে অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসের অনেকবাঙালি অফিসার বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনেপাকিস্তানের চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষেকূটনৈতিক কার্য চালিয়ে যান। তাছাড়া ইউরোপেরবিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকা ও কানাডায় অবস্থানরতবহু বাঙালি ছাত্র, শিক্ষক, চাকরিজীবী, গবেষক ওঅন্যান্য পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার-প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ওভারত সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র ওঅন্যান্য সহায়তা দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনপাকিস্তানের পক্ষে ছিল। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুসংসদ সদস্য ও সিনেটর, বুদ্ধিজীবী ও জনগণবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করেন। এ যুদ্ধছিল প্রকৃতই একটি জনযুদ্ধ।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীরওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ আরো জোরদার হয়এবং বিপর্যস্ত হতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদেরদোসররা। নিয়মিত বাহিনীর কর্মকর্তা ও জওয়ানদেরনিয়ে ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতিজেনারেল ওসমানী ২২ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদেরঅপারেশনের বিষয়ে একটি বিস্তারিত নির্দেশনাবলিজারি করেন। ২৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনআহমদ যুদ্ধ পরিস্থিতি বর্ণনা করে জাতির উদ্দেশেভাষণ দেন। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধেনভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয়বাহিনীর যৌথ কমান্ড সৃষ্টি হয়। লেফটেন্যান্টজেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে যৌথ বাহিনীরকমান্ডার নিয়োগ করা হয়।

২১ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনীভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বিএসএফের সহায়তায়সীমান্ত অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়টি শক্তঘাঁটি দখল করে নেয়। নভেম্বরের শেষার্ধে মুক্তিবাহিনীসীমান্ত ও দেশের অভ্যন্তরে তাদের আক্রমণজোরদার করে। এখানে উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিকঅবস্থা থেকেই কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, বাতেন বাহিনী প্রমুখ বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে গেরিলাও সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী সক্রিয় হলেউপায়ান্তর না দেখে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতেরবিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পাকিস্তানের বিমান বাহিনীভারতের পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি শহরে বোমা বর্ষণকরে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও পাকিস্তানেরবিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দেন। ওইদিনইভারতীয় মিত্রবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েবাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। যুদ্ধের দ্বিতীয়দিনেই ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণেবাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমানও ঘাঁটি অকার্যকর হয়ে যায়। মিত্রবাহিনী দেশেরচারদিক থেকে ঢাকা অভিমুখে অভিযান শুরু করে।বাংলাদেশ ও ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীনরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্ববাসীর কাছেআবেদন জানায়। ৪ ডিসেম্বর ভুটান এবং ৬ ডিসেম্বরভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারে, যুদ্ধ শেষ হতেআর বেশি দেরি নেই। মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রায়পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোণঠাসাহয়ে পড়ে। তারা সর্বত্র পিছু হটতে থাকে। ৫ডিসেম্বরের পর থেকে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকামুক্ত হতে থাকে। বিভিন্ন এলাকায় পরাজিত পাকিস্তানিবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে থাকে। ১২ ডিসেম্বর থেকেবেতারে ও টিভিতে ভারতের প্রধান সেনাপতিজেনারেল মানেকশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকেআত্মসমর্পণ করার ঘোষণা দিতে থাকেন। ভারতীয়বিমান বাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমণে বাংলাদেশেঅবস্থানরত পাকিস্তান আর্মি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ১৪ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানজেনারেল নিয়াজিকে পাকিস্তানিদের প্রাণ রক্ষার্থেআত্মসমর্পণ করতে বলেন। ওইদিনই ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকার গভর্নর হাউজে বোমা বর্ষণ করে। পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মালেক পদত্যাগ করেরেড ক্রসের নির্ধারিত এলাকায় আশ্রয় নেন। ১৪ ও১৫ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানি বেসামরিক সরকার ওসামরিক কর্তৃপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘেরমাধ্যমে যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নেয়। ভারতীয় বাহিনীরপ্রধান জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সহজকরার জন্য ১৫ ডিসেম্বর বিকাল ৫টা থেকে পরেরদিন বেলা ৩টা পর্যন্ত ভারতের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতিঘোষণা করেন। মিত্রবাহিনী ১২ থেকে ১৪ ডিসেম্বরেরমধ্যে ঢাকার চারদিকে উপস্থিত হয়ে ঢাকা অবরোধকরে। পূর্ব থেকে ঢাকায় ও আশপাশে অবস্থানরতগেরিলারা মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। ১৬ ডিসেম্বরসকালে জেনারেল নিয়াজি তার অধীনস্থদেরযুদ্ধবিরতির নির্দেশ দেন।

১৪ ডিসেম্বর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানেস্মরণকালের এক নৃশংসতম ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানিসেনাদের মদদপুষ্ট রাজাকার, আলবদর, আল শামসপ্রভৃতি বাহিনী দেশের বুদ্ধিজীবী তথা বিশ্ববিদ্যালয়েরপ্রথিতযশা শিক্ষক, সাহিত্যিক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারদের ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেজাতিকে মেধাশূন্য করার প্রয়াস নেয়। মুক্তিযুদ্ধেরশেষ দিকে হায়েনাদের এমন অপকর্ম তাদেরপ্রতিহিংসা ও হীনম্মন্যতার চূড়ান্ত প্রকাশ বলে মনেকরা হয়।

মিত্রবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে যুদ্ধবিরতিও আত্মসমর্পণের সমঝোতার পর ভারতীয় ইস্টার্নকমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব ১৬ডিসেম্বর দুপুরের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছেন। লেফটেন্যান্টজেনারেল এএকে নিয়াজিকে বেলা সাড়ে ৩টার দিকেতেজগাঁও বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকাল৪টায় হেলিকপ্টারে করে মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ওভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্টজেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ঢাকায় পৌঁছালেজেনারেল নিয়াজি ও জেনারেল জ্যাকব তাকে স্বাগতজানান। এস-ফোর্সের অধিনায়ক ও ৩ নং সেক্টরকমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহওবিমানবন্দরে জেনারেল আরোরাকে অভ্যর্থনায়উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৪টায়রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সমরাধিনায়কলেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজি কয়েক হাজারসেনা অফিসার ও সৈনিকসহ বাংলাদেশে নিয়োজিতসব পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর (প্রায় ৯৩ হাজার) পক্ষেআত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। মিত্রবাহিনীর পক্ষেস্বাক্ষর করেন ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ওভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের অধিনায়কলেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খন্দকার, বাংলাদেশ নিয়মিতবাহিনীর দুটি ইউনিটসহ চার ব্যাটালিয়ন সৈন্য, কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা এবং এক বিশালহর্সোত্ফুল্ল জনতার উপস্থিতিতে ‘জয় বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু’, ‘আমার দেশ, তোমার দেশ, বাংলাদেশবাংলাদেশ’ প্রভৃতি স্লোগানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানিবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমর্পণ স্থলে নিয়েযাওয়ার সময় তার ডান ও বাম পাশে ছিলেনযথাক্রমে জেনারেল অরোরা ও মুক্তিবাহিনীর ২ নংসেক্টরের উপ-কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দার। ১৬ডিসেম্বর দুপুরের মধ্যেই কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধানকাদের সিদ্দিকী ঢাকায় পৌঁছেন। আত্মসমর্পণঅনুষ্ঠানে ছিলেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। তবে সেক্টরকমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ রেসকোর্সময়দানে উপস্থিত ছিলেন বলে অনেকের মত। যদিওআত্মসমর্পণের ছবিতে তাকে দেখা যায় না। জেনারেলওসমানী ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমানসিলেটে অবস্থান করছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের পরথেকে সর্বশেষ ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশেরবিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরাবিভিন্ন সময়ে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।ঢাকা সেনানিবাসের সৈন্য ও অফিসাররা আনুষ্ঠানিকআত্মসমর্পণ করেন ১৯ ডিসেম্বর।

মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি এবং বাংলাদেশ শত্রুমুক্তহলেও তখনো বাঙালি বিজয়ের আনন্দ পূর্ণরূপেউদযাপন করতে পারছিল না। বঙ্গবন্ধু পশ্চিমপাকিস্তানে কেমন আছেন, কবে ফিরবেন তা নিয়েসবার মধ্যেই ছিল উত্কণ্ঠা। অবশেষে জাতির পিতাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারথেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশেপ্রত্যাবর্তন করলে সেদিন বাঙালি উদযাপন করেপ্রকৃত বিজয়ের আনন্দ। সারা দেশ থেকে লক্ষ লক্ষমানুষ ঢাকায় এসে বিজয়োল্লাস করে বঙ্গবন্ধুকে বরণকরে নেয়।

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিবও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান; বর্তমানেজার্মানিতে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত