সত্য সুন্দরের সন্ধানে-১৩ ” নিজেকে সুখী না করে অন্যকে সুখী করা যায় না “
রাজু আহমেদ মোবারক:
3)
“The mouth of the righteous is a foundation of life. He who guards his lips guards his life.”— Proverbs
আমরা কখনোই মন খারাপ নিয়ে মনোরম মনপ্রাণ নিয়ে প্রিয়জনদের সাথেও হাসতে পারিনা, আনন্দও করতে পারিনা। আমরা যেন আমাদের সুখের জীবনের সাথে সমাজের জন্যও আমাদের একটু চেতনা থাকে। আমরা একা কখনোই সুখী মানুষ যেমন হতে পারি। আমরা একা চাইলেও সুন্দর ভাবে হাসতে পারিনা। সুন্দর হাসির জন্যও পাশে সঙ্গী সাথী প্রয়োজন হয়। না হয় হাসির সৌন্দর্য ও মাধুর্য প্রবল উচ্ছ্বাসের সাথে ফুঁটেও উঠে না। যাকে ভালোবাসা যায়, তার সাথেই মন খুলে হাসা যায়। মুখে ভালো হাসি ফুঁটিয়ে তোলার জন্য কিছু ভালোবাসার মানুষ দরকার যা আমাদের স্বামী-স্রী, সন্তান-সন্ততি, মা-বাবাসহ আরো কাছের কিছু মানুষ। আমার-আপনার জীবন সুখ ও আনন্দময় না হলে অন্যকে সুখী ও খুশি করা যায় না। পৃথিবীর কোন মানুষই কেউ কাউকেই সুখী ও খুশি করতে পারেননা যদি তারা নিজেরাই নিজেদের
সুখ শান্তি খোঁজার কাজগুলো না করেন। নিজে সুখী হওয়ার দায়িত্ব নিজেরই নিতে হয় তা পূর্ণাঙ্গ সত্য, কিন্তু সুখের জীবন তো পরস্পরের সাথে পরস্পরে সংযোজিত। দুইটা সুন্দর মন পাশাপাশি এলেই অন্তরের সংযোজন ঘটে যা প্রিয়জন-প্রিয়মন পায় সুখের পরশে। আমরা পরস্পর পরস্পরে সুন্দর ও ভালো মানুষ হতে চাই। আমাদের চলাফেরায়, কথাবার্তায়, বৈশিষ্ট্যে, ব্যক্তিত্বে ও চরিত্রে সুন্দরের সমাহার ফুঁটিয়ে তুলতে চাই। আমরা যখন আমাদের জীবনে চরিত্রের সুন্দরের রূপটুকু পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষের কাছে নিতান্তই আদর্শিক ও সন্মানে প্রকাশ করার জন্য নিরলস চেষ্টা করি, আমরা যেন আমাদের শব্দের প্রতি সম্মান প্রদর্শনও করি। আমাদের জীবনে আমরা সুখের প্রত্যাশা নিজেদের অন্তরে পোষণ করি। একই সাথে আমরা প্রতিদিন মানুষের সাথে যে কথাবার্তা বলি, সেগুলো যেন মূল্যবান শব্দ হয়। আমরা ধন সম্পদে যথেষ্টই পরিপূর্ণ হতে পারি, কিন্তু সুখানুভুতি প্রাণে সঞ্চার করার জন্য মনোরম শব্দ চয়ন পরস্পরে পরস্পরের জন্য
ভীষণ প্রয়োজন। কারণ, ভালো শব্দের প্রায়োগিক ব্যবহারেই আমরা পরস্পরে সংযুক্ত হই এবং পরস্পরে কাছাকাছি আসি। আর মন্দ শব্দসমূহ আমাদেরকে হৃদয় স্পর্শের কাছ থেকে অনেক দূরে ও দূর্বল সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবেই নিয়ে যায়। আমরা জীবনে সুখী হতে চাই এবং অন্য মানুষদেরও সুখি করতে চাই। নিজেদের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যতার অভাব রেখে তুমি ভালো মানুষ হতে চাইলেও হতে পারবে না। কারণ
তোমার অর্থনৈতিক দৈন্যতা তোমার মানসিকতাকে দুর্বল করে অসৎ মানুষেও পরিণত করতে পারে। আমরা যেন সত্য পথে আমাদের মনটি রেখে সৎ মানুষ থাকি। আমাদের নিজেদের মুখে হাসি ফুঁটিয়ে অন্তরে খুশির মাত্রা যোগ করতে চাই। কিন্তু, এইসব সংঘটিত করার জন্য যা করা দরকার সেই কাজও করা ভীষণ প্রয়োজন। পৃথিবীর মানুষের জন্য অনেক ভালো কাজ যথেষ্ট পরিমাণ করার সুযোগ রয়েছে। তার প্রথম কাজই হলো নিজেকে ভালো মানুষের মর্যাদায় নিয়ে আসা। তুমি নিজে ভালো ও উপযুক্ত মানুষ না হলে তুমি কখনোই অন্যের জীবন চলার জন্য কোন কাজই করবে না। অন্যের জন্য ভালো কিছু করার জন্য তোমার বিবেক বুদ্ধির উন্মেষ এবং ভালো মন থাকা প্রয়োজন। না হয় তুমি কিছুই করতে পারবে না। কারণ, তোমার মনই তোমাকে ভালো
কাজ করার জন্য কারো জন্য সায় দেবে না। কারণ, তুমি তোমার মনকে সুন্দরের আবহে সংযোগ কর নাই। এই পৃথিবী অনেক সুন্দর। এই সুন্দর পৃথিবীতে আমরা যেন সুখী মানুষ ও সুন্দর মনের মানুষ হই। আমাদের মৃত্যুতে, আমাদের মৃত্যুর বিদায় যদি মানুষের কাছে ব্যথাতুর না হয় তাহল বুঝতেই হবে মানুষের সাথে আমাদের ভালবাসার সম্পর্ক প্রাণের ছিল না। অমানুষ হয়ে মরে আমরা কেউ-ই আমাদের মৃত্যুর দিনে মৃত্যুর সৌন্দর্য ফুঁটিয়ে তুলতে পারবনা বিদায়ী মানুষের কাছে। আমি-আপনি অমানুষ হয়ে মরে গেলাম! আমি-আপনি কি আমাদের সন্তানদের, পরিবারের ও সমাজের কোন উপকারে বা সন্মানে এসেছি? আমাদের সন্তানরা যেন আমাদের ভালো কাজের গর্বে গর্ববোধ করতে পারেন এমন বাবা-মা যেন আমরা হই। অবশেষে, আমরা চলে যাবার সময় আমাদের শরীরটির প্রতি মানুষের যেন কোন ঘৃণা না আসে। আমরা মরে গেলে যদি চরিত্রহীন হয়ে মরি, মানুষ আমাদেরকে প্রতিদিন অপমান করবে। আমরা যেন সেই অপমানের যাতনা থেকেও বাঁচি। এই যাতনার যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য আমরা মানুষের ক্ষতি না করে যেন প্রতিদিন ভালো হয়ে চলি। এই পৃথিবীর মানুষের মাঝে দুইটা দল রয়েছে। একটা হচ্ছে ভালো মানুষের দল। যারা তারা নিজেরাই নিজেদের অন্তরে মানুষের কল্যাণে কাজ করে ফুঁটে থাকেন এবং ফুঁটে উঠেন। আর অন্যটা হচ্ছে মন্দ মানুষের দল। যারা চুরি-দুর্নীতি-ঘুষ-হত্যাকান্ডের মতো নানান নষ্টতার মাঝে নিমজ্জিত থাকেন। এই দুই দলের মধ্যে থেকে দল পছন্দ একান্তই আমাদের নিজেদের। আমাদের পছন্দের কারণেই আমরা এই দুইটার একটা হয়ে মরি। আমাদের কেউ যাতে আমাদের মৃত্যুর পরে অপমান না করে, সেই মরণেই যেন আমরা মরি। পৃথিবীর সৌন্দর্য নষ্ট করে, প্রচণ্ড ঝটিকার মত সমস্ত যেন ওলট পালট না করে মরি। আমরা যদি সমস্ত ওলট-পালট করে মরি, এই দুই স্হানে আমাদের ওলট-পালটই থাকতে হবে। যা আমাদের ইহকাল ও পরকাল।
4)
“The deepest principle of human nature is the craving to be appreciated.”— William James
আমরা যখন সুখী ও খুশি থাকার জন্য স্বপ্ন দেখি, আমরা যেন অন্তরের
সৌন্দর্যের প্রতি যত্নশীল থাকি। পরিবার ও সমাজ নিয়েই আমাদের জীবনের সৌন্দর্য। আমাদের হৃদয়ে যখন আনন্দ ও সুখের অনুভূতির মাত্রা ত্বরান্বিত করে পরিবার-পরিজন, অন্যান্যদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক নিয়ে চলতে পারি তবেই আমরা সুখি মানুষ। আমরা কখনো কখনো কাছের মানুষ কাছে থেকেও কাছে নেই। কাছের মানুষ কাছে থেকেও অন্তরের খবর আমরা কেউই কারো রাখতে চাই না। মানুষের অন্তর অত্যন্ত মূল্যবান অনুভূতির সম্পদ। আমাদের মন যদি একটুতেই নষ্ট হয়ে পড়ে অন্যের অপবাদ ও আঘাতে, সেই মনকে পূর্বের স্হানে ফেরত আনা কঠিন হয়ে পড়ে। কাছের মানুষকে কাছে রাখা যায়, যদি আমরা পরস্পর পরস্পরের সম্পর্কে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করি। মানুষের সম্পর্ক যদি নির্মল না থেকে কুৎসিত হয়ে পড়ে, কাছে বাস করেও দেখাদেখি ও বলাবলি পর্যন্ত হয় না। আমরা যদি সুখী মানুষ হতে চাই, সকলের সঙ্গে সম্পর্কে যদি প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও অন্তরকে রন্জিত করতে নাও পারি আমরা
যেন নিকটতম প্রিয় মানুষ স্বামী-স্রী, সন্তান, মা-বাবা তাদের সাথে যেন প্রাণের তরঙ্গে চলি। আমরা যদি বড় লোক না হয়ে, বড় ভালো মানুষ হই। তখনই আমরা অন্তরে ও অনুভবে সুখী মানুষ হতে পারি যখনই আমরা আমাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্ধেষ দূর করে চলি। আমাদের কার কত ধন-সম্পদ আছে, তা দিয়ে আমরা সুখী হতে পারি না। যা আছে তা দিয়ে সন্তুষ্ট থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে, মধুর সম্পর্ক রেখে জীবন চালিত করি তবেই আমরা সুখী মানুষ হই। আমরা সত্যিই যদি সুখী মানুষ হতে চাই, পাপাচার, অন্যায়, অপরাধ মন্দ কাজ করে মনের পবিত্র সম্পর্ক নষ্ট করে, পরস্পরে পরস্পরের মন থেকে যেন নির্বাসিত না হয়ে পড়ি। আমরা সুখী হওয়ার জন্য সুখের সংগা যেভাবেই দিতে চাই না কেন, যতই সুন্দর মনের মানুষ হই না কেন, আমাদের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যতা অনেক বেশিই প্রয়োজন। যে’জন নিজের সুন্দর চরিত্র নিজের অন্তরে নিজেকে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন না রাখেন, অন্যান্য মানুষের কাছে তিনি বা তারা কখনোই মনোরম মানুষ নয়। যারাই জীবনে সুখের সন্ধানে থাকেন, তারা সততা ও সত্যাচারের মাঝেই জীবন চালিত রাখেন। নানা ধরনের জটিল কাজ করে, মানুষের জীবনের সৌন্দর্য নষ্ট করে, আমরা কখনোই সুখী মানুষ হতে চাইলেও সুখী হতে পারি না। কারণ,পাপ আর অশান্তির যন্ত্রণা ও মতিচ্ছন্নতা জীবনকে দূর্বিসহ করে রাখে। ফলে পারিবারিক, সামাজিক সমস্ত
মধুময় সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় বিধায় সুখী হওয়ার জন্য সুখের সৌন্দর্য যা মানুষের অন্তরে অন্তর্গত হয়, তা সর্বনাশার অতল গহীনে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। সত্য সুন্দরের সন্ধানে সমস্ত সুন্দরের রূপ যেন আমাদের নিজেদের জীবনে অর্জন করি। অসুন্দর মনের মানুষ হয়ে সুখী মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখা, প্রাচুর্য্যের প্রাতিষ্ঠানিক জীবন পেতে পারলেও প্রকৃতই সুখের জীবন বিষম কষ্টের। নিজেকে সুখী না করে, অন্যের জীবন কখনোই সুখী করা যায় না। এই পৃথিবীর সকল মানুষকেই নিজের সুখার্জনের কাজ তাদের নিজস্ব মন দিয়েই করতে হয়। যা মানুষে মানুষে পারস্পরিক সুন্দর সম্পর্কের আলোকে। আমাদের সুখানুভূতি এবং শান্তি একান্তই নির্ভর করে আমাদের আপন মানুষের সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক ও শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসার উপর। যা অন্তরে কানায় কানায় ভরে উঠে। আমরা যখন প্রিয়জন আপনার হয়ে, সকলেই সকলের মনকে হৃদয়ের স্পর্শে অনুভব করে, অন্তদৃষ্টিতে চলতে সক্ষম হই, তবেই আমরা সুখ অনুভব করি অন্তরে পরস্পরে।
“He who sows courtesy, reaps friendship, and he who plants kindness, gathers love.”– Needles and Friends
লেখক: কলামিস্ট, গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক।