ঢাকা | ডিসেম্বর ২২, ২০২৪ - ৯:১৩ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম

সত্য সুন্দরের সন্ধানে-১৩”নিজেকে সুখী না করে অন্যকে সুখী করা যায় না “

  • আপডেট: Thursday, November 3, 2022 - 11:34 am
  • পঠিত হয়েছে: 135 বার

রাজু আহমেদ মোবারক:

1)“I can live for two months on one good compliment.” — Mark Twain

আমাদের মনই সুখে ও শান্তির পরশে থাকার জন্য প্রধান কাজ করে আমাদের মস্তিষ্কের শক্তির মাধ্যমে। আমাদের মন যা চাই আমাদের মস্তিস্ক তা-ই করে। আমরা সবাই সুখের পরশ পেয়ে খুশি থাকতে চাই। আমার সুখের মনই আমাকে খুশি রাখে অন্তরে ভালোলাগার পরম অনুভবের সিক্ত প্রাণ রসের তৃপ্তিতে। আমি আমার নিজের অন্তরে যদি সুখের জীবন খুঁজে না পাই, আমি কখনোই অন্যের জীবনে সুখের বার্তা দিতে চাইলেও দিতে পারব না। কারণ, আমার নিজের মনই তখন অশান্তির চরম বেদনায় ভারাক্রান্ত থাকবে। অশান্ত মনের মানুষ অস্থির থাকেন বিধায় সুখ অন্তরে অনুভব করার জন্য মনের ভেতর নিজেকে ভালোলাগার মন তৈরী হয় না, যা দ্বারা মানুষ শান্তি অনুভব করেন। বিশেষ করে, সত্য সুন্দরের সন্ধানের পথে যে শান্তিময় জীবন আছে, যেখানে হিংসা বিদ্ধেষের আলামত যথেষ্টই কম থাকে। সেই জীবনের মাঝেই মানুষ নিজেকে সুখী করে অন্যের জীবনেও সুখের বার্তা কিছুটা হলেও পৌঁছুতে পারেন। মানুষের জীবনের সুখ মূলত দেওয়া নেওয়ার ওপরই নির্ভরশীল। এই দেওয়া নেওয়ার মিলনে আমরা পরস্পর পরস্পরকে ভালো বেসে যাচ্ছি। আবার আমরাই পরস্পর পরস্পরের কাছেও যাচ্ছি সুখানুভূতির জন্য। পরস্পরের মধুর সম্পর্কে আমরা

হাসি খুশির দিন যাপনও করে যাচ্ছি। এরই মাঝে কখন কোন্ কারণে হঠাৎই আমরা ঐ হাসি খুশির মধুর সম্পর্ক নষ্ট করে দূরের পথে চলেই চলি,  তা কখনো কখনো টেরই পাওয়া যায় না। কারণ, মন যে বড়ই অদেখা সংবেদনশীল অর্গান একটুতেই নেচে উঠে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে। আবার সামান্য কোন কারণেই যখন-তখন বদলে যায় গিয়ে বাড়িসুদ্ধ সকলেরই সর্বনাশ করে ফেলে রাগের মাথায়। এই রাগ অভিমান পরিবার ছেড়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।

আমরা অনেকেই লোলুপতায় পড়ে চারিদিকের ক্ষতিসাধন করি।

এইও সত্য, অনেক বিশিষ্ট ভদ্রলোকেরা সমাজ ও রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনাকালে লোভ সামলাতে না পারার কারণে  চুরি-দুর্নীতি-ঘুষ এসব কদর্যপূর্ণ কাজে নিমজ্জিত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের বড় ক্ষতি করে ফেলেন। তারাই নিজের ও পরের ঘরের শান্তি চোর হিসেবেই অভিহিত হন। শেষ বয়সে ভেতরে ভেতরে অশান্তির যাতনা নিয়েই তারা পরম দুঃখ নিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। কারণ তাদের চুরি-দূর্নীতি-ঘুষ এসব নিত্যদিনের ঘটনা প্রবাহের কথা কারো সাথে বলে যেতে পারেননি বিধায় মৃত্যুশেলের যাতনা একান্তই নিজের হয়েই থাকলো! যারা রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাৎ করেন, ওরা আমাদের অন্তরের সুখ-শান্তি ও হাসি নষ্ট করে দেয়। এদের অনেকেই আমাদের সহকর্মী ও বন্ধু এমন কি ভাই-বোন।

আমরা অনেকেই এদের বিষাক্ত ও নষ্টতার জীবন থেকে আলাদা হয়ে যাই। কারণ, এসব অসুন্দর মনের মানুষের সাথে সুন্দর সম্পর্ক রাখা, এমন কি বন্ধুত্বের সম্পর্কে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে চলাফেরা করা বেশ কষ্টকর  হয়ে পড়ে। এদের সাথে আনন্দ-উল্লাস, হাসা হাসি করার মনও পাওয়া যায় না। আমরা কখনোই সবাইকে খুশি করে চলতে পারিনা এবং পারাও যায় না। সবাইকে সংগে নিয়ে জীবনে এক সাথে চলতেও পারা যায় না। আমরা আমাদের চিন্তার চরিত্রে ভিন্ন। পারিবারিক সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও চেতনায় ভিন্ন। কিন্তু এই ভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে নিয়েই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতর আমাদের চলতে হই। এই সকল মানুষের জীবন চলার মধ্যেই আমাদের সকলের সুন্দর জীবন চালিত করতে হই। তাদের সাথেই আমাদের হাসতে হই। তাদের সাথেই আমাদের কাঁদনও করতে হই। এই হাসি-কান্নার জীবনের মাঝেই আমরা আমাদের অন্তরের সুখ খুঁজে বের করি। আমরা যখন পরিবারে পরিবারে, সমাজে সমাজে সম্পর্ক রক্ষা করে চলি, কেউ কাউকে যেন রাগিয়ে-অপমান না করে চলি। মানুষ জীবনে দুঃখ কষ্ট ভুলে যেতে পারেন। কিন্তু কেউ কাউকে অপমান করলে তা কখনোই ভুলতে পারেন না। অপমানে চেনা লোকও অচেনা হয়ে যায় অন্তরে। এই সুন্দর পৃথিবী আমাদের সকলের জন্যই আল্লাহ উপযোগী করেই সৃষ্টি করে রেখেছেন। এই পৃথিবীর কোন কিছুই আমাদের একার নয়।

এই পৃথিবীর আলো বাতাস আমাদের সকলের। তবুও অনেক কিছুই রাষ্ট্রের নিয়ম মেনে, শৃংখলিত মানুষ হিসেবে পরস্পরে বাস করার জন্য

সমাজবদ্ধ মানুষ হয়ে বসবাস করতে হয়। তা না হলে আমরাই পৃথিবীর সৌন্দর্য নষ্ট করে এখন যা আছে তার চেয়েও আরো খারাপ করে ফেলতাম। অনেক মানুষের মনেই লোলুপ দৃষ্টি থাকে। যা চোখের লোলুপ দৃষ্টির চেয়েও অনেক ভয়ানক। এরা পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের কোন সৌন্দর্যই অন্তরে অনুভব করেন না। অন্যের জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেও নিজেদের জীবনের উন্নতি চায়। এরা নিজেদের

সৃষ্ট কোন অন্যায-অপরাধ অন্তরে অনুভব করেন না। এরা কখনোই অন্যের জীবনে সুখের পরশ নিজেদের মেলানো প্রয়োজন বোধও করেন না। এরা একে অন্যে এক সাথে চলাফেরা, কথা বলাবলি করলেও কিন্তু  অন্তরে জানাজানি, বুঝাবুঝি একেবারেই হয়নি। আমরা যদি জীবনে সুখী মানুষ হতে চাই, প্রিয়জনদের সাথে যেন প্রিয়মণ নিয়ে জানাজানি ও বোঝাবুঝিটুকু অন্তর থেকেই থাকে। সত্য সুন্দরের সন্ধানে যারাই জীবনের পথ খুঁজেন, তারা তৃপ্তিবোধ অনুভব করে মনপ্রাণ দিয়ে অন্যের জীবনের সুখ ও তাদের মুখের হাসি দেখতে চান। তারা অন্যের জীবনের দুঃখে ও কষ্টে ব্যথা অনুভব করেন। তারা কখনোই অন্যের সাথে তিক্তস্বরে কথাও বলেন না। কারণ, তাতে অন্তরের সৌন্দর্য ও মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায়। নষ্টতার আদিষ্টতায় যারাই জীবন চলার পথ খুঁজেন, তারা কখনোই মনোরম মন নিজেদের অন্তরে খুঁজে পায়না সুখ শান্তি। অন্যকে

খুশি করার জন্য নিজেকেই খুশি রাখাই জরুরী।

2)

“When people are laughing, they are generally not killing one another.”– Alan Alda

সত্য সুন্দরের সন্ধানে থেকে আমরা যখন আমাদের কাজের সন্ধানে, জীবনের জন্য জীবিকার সন্ধানে প্রতিটা মুহূর্ত অতিক্রান্ত করি, আমাদের হৃদয় সব সময়ই যা ভালো সেটিই যেন খুঁজে। আমরা সবাই তো সুন্দর জীবন চাই। সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে থাকতে চাই। এই সুন্দর জীবন নিয়ে সুখে ও শান্তিতে থাকার জন্য আলোকিত মানুষ  সুন্দর মন দরকার। আমাদের চরিত্রের কাঠামোর মাঝে যদি মন্দত্বের আধিক্যতা বেশি থাকে, যা মনের সৌন্দর্যকে সংকোচিত করে ফেলে এতে ভালোর শক্তির বিকাশ অন্তরে নষ্ট হতে শুরু করে। অন্তরের ভালোর শক্তির বিকাশ নষ্টতার দিকে ধাবিত হলে, জীবনে সুখী হওয়ার ও সুখে থাকার সৌন্দর্যের পরিবেশ অন্তর থেকে নির্বাসিত হয়ে যায়।

কারো নিজের জীবনে সুখ ও শান্তি বিরাজমান না থাকলে, অন্য মানুষের জীবনে সুখের চিন্তা করা এবং তাদের পাশে থাকা যায় না। নিজেকে নিবিষ্ট চিত্তে উপযুক্ত করতে পারলেই বেশি মানুষকে সহযোগিতা করা যায়, কিন্তু সেই ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার জন্য পরম সৌন্দর্যের মনও থাকা চাই। আমাদের অন্তরে সুন্দরের সাংস্কৃতিক

পরিবেশ অনেক দরকার। আমাদের অন্তরের ভেতরের সৌন্দর্য নষ্ট করে, সুখী ও খুশি থাকা যায় না। আমাদের অন্তরেকে বিষাক্ত করে অর্থাৎ বিষ ঢেলে রেখে চাইলেই কি বিষমুক্ত মানুষ হওয়া যায়? কারো সাথে কি বিষাক্ত মন নিয়ে মধুর সম্পর্ক করা যায়? সুন্দর সম্পর্কের জন্য উপযুক্ত ও সুন্দর মন অন্তরে প্রতিষ্ঠা করা দরকার মনোরম প্রাণে।

আমার-আপনার চিন্তার মাঝে যদি সাধনা করার মনোরম মন না থাকে, অন্যকে কখনোই বলা যাবে না যে তুমি মনোরম প্রাণের মানুষ হও। কেউ পাপাচারে লিপ্ত থেকে তার সন্তানদেরও নিষেধ করার মনন শক্তি পাবে না। হে সন্তানরা, তোমরা পাপাচার ও অত্যাচার লিপ্ত হইও না-এই কথা বাবা-মা তাদের সন্তানদের বলতেই পারবেন না। যারাই চুরি-দুর্নীতি-ঘুষ-হত্যাকান্ড এসব কাজে নিয়োজিত থাকেন তারা কখনোই তাদের সন্তানদেরকে এই সমস্ত স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর কর্মকান্ড করা থেকে বিরত থাকার প্রাণ পর্যন্ত পায় না কারণ তারা নিজেরাই বিষাক্ত মানুষের দলে আবদ্ধ। যারাই সত্য সুন্দরের সন্ধানে সুন্দরের রূপের স্বরূপ অন্তরে উন্মোচন করে চলেন, তারাই অন্যের সুখের জীবন তৈরী করার জন্য কিছুটা হলেও সরস প্রাণ পাবেন। আমাদের অন্তরের সৌন্দর্যের মাধুর্যই যা আমাদের সুন্দর মন  দিয়েই আমরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষের সাথে পারস্পরিক মধুর সম্পর্কের মাধ্যমেই আমরা সুখী মানুষ হয়ে থাকতে পারি। আমার আমিত্বের মাঝে যদি সুখের পরশ না থাকে তাহলে আমার আচরণে, আমার ব্যক্তিত্বে তা কখনোই ফুঁটিয়ে তুলতে পারব না অন্যের সাথে। এমন কি জীবন চলার পথে অন্যের সাথে ভুল-ভ্রান্তি হলেও নিজের মনে কোনই অনুতাপ ও অনুশোচনা জাগ্রত হয় না।

এটাই সত্য যে, আমাদের অন্তর যখন বিষাক্ততায় আচ্ছন্ন থাকে ইহা কোনও না কোনও ভাবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কলুষিত করবেই বা করে। এই কলুষিত মন আমাদের ব্যক্তিত্বে, আমাদের আচরণে এর মন্দ প্রভাব পড়ে। আমাদের এই কলুষিত মন্দ আচরণ সমাজের সর্ব ক্ষেত্রেই

ছড়িয়ে পড়ে। আমি-তুমি যদি সুখী মানুষ হতে চাই, অন্তরে সুখ অনুভব করতে চাই, শান্তিতে থাকতে চাই তবে যেন আমাদের অন্তরের যত্ন জীবনের শুরু থেকেই শুরু করতে চাই। আমাদের মনটি যেন লোলুপতাকে পরিত্যাগ করে সত্য সুন্দরের সন্ধানে সত্যাশ্রিত পথে আরোহণ করে। আমাদের অন্তরের মনোরম সুন্দর চেতনার সৌন্দর্যই

আমাদেরকে সুখী এবং খুশি রাখতে পারে। আমরা যখনই আমাদের জীবনে বাজে কাজ করা থেকে বিরত থাকি, পরম সুখে থাকার প্রাণও পেয়ে থাকি। মানুষের জীবনে বাজে কাজ করে অর্থবিত্ত অর্জন করা যায়, কিন্তু সুখি হওয়া যায় না। আমাদের সুখের ও মাধুর্য ভরা সুন্দর ও সুখের নিরাপদ জীবনের জন্য সুন্দর সম্পর্ক তোমাতে-আমাতে প্রয়োজন। যেখানে স্নেহপ্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এসব কিছুই আমাদের জীবনের সুখের ও শান্তির উপাদান। তুমি যখন তোমার নিজের মনের ভেতর সুখের পরশ পাবে, পাশের মানুষের জীবন যাপন সুখের ও খুশি দেখার মধ্যেই তোমার নিজের আনন্দ খুঁজে পাবে। আমরা মানুষের ক্ষতিসাধন করে প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হতে পারি, সমাজ ও রাষ্ট্রে ক্ষমতালোলুপ ব্যক্তি হতে পারি, কিন্তু সুখী ও শান্তিপ্রিয় মানুষ আমরা ক’জনই হতে পারি ?

লেখক: কলামিস্ট, গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক।